বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে খাদ্য, জ্বালানি ও অর্থবিষয়ক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গঠিত প্লাটফর্ম ‘চ্যাম্পিয়নস গ্রুপ অফ গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স (জিসিআরজি)-এর উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে শুক্রবার রাতে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাব রাখেন।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কারণে বিশ্বজুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে জিসিআরজি গঠনে এগিয়ে আসে জাতিসংঘ। এই গ্রুপের মূল্য উদ্দেশ্য যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্বের দরিদ্র ও ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেয়া। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা এই গ্রুপে যোগ দিতে সম্মত হয়েছেন।
গত ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জিসিআরজি গঠনের কথা জানান অ্যান্তোনিও গুতেরেস। এ বছরের ১৩ এপ্রিল জিসিআরজিতে যুক্ত হতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন দিয়ে আহ্বান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে সম্মতি জানান প্রধানমন্ত্রী।
যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সভাপতিত্বে এদিন জিসিআরজির প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই বিশ্ব সংহতি জোরদার করতে হবে এবং একটি সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে জি সেভেন, জি টোয়েন্টি ও ওইসিডি এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এটা দেখে আমি খুশি হয়েছি যে, এই গ্রুপের স্টিয়ারিং কমিটি সব বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত। সংকট মোকাবিলায় কার্যকর সুপারিশ গ্রহণে তাদের উদ্যোগে আমাদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে।’
দ্বিতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং সাপ্লাই চেইনের ঘাটতি মোকাবিলা সবচেয়ে জরুরি, যা পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। স্বল্পোন্নত দেশ এবং অন্যান্য দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোকে রক্ষায় বিশ্ব বাণিজ্য ও রপ্তানি আয় ঠিক রাখতে আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন।
উন্নত অর্থনীতি ও বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার এবং আরও সহজলভ্য অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।’
তৃতীয় প্রস্তাবে সরকারপ্রধান বলেন, ‘খাদ্য মজুত ও বিতরণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে কৃষি খাতের জন্য প্রযুক্তি সহায়তা এবং বিনিয়োগের ওপর আরও বেশি মনোযোগ দেয়া জরুরি।
পদ্মা সেতুতে নিয়ে খালেদাকে টুস করে ফেলে দেওয়া উচিত : প্রধানমন্ত্রী
স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘জিসিআরজিকে এগিয়ে নিতে আমরা উত্তর-দক্ষিণ, দক্ষিণ-দক্ষিণ এবং ত্রিভুজাকার সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সুবিধা নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ততাও গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।’
চতুর্থ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৪৮টি সদস্য রাষ্ট্রের সংগঠন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি হিসাবে আমরা অনেক দ্বীপ রাষ্ট্র এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সেসব দেশে কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা গুরুতর চাপের মধ্যে রয়েছে।’
তাই সবার কল্যাণে জলবায়ু পরিবর্তন, জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অর্জিত জ্ঞান, বোঝাপড়া এবং অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়াটা দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের যুদ্ধ এমন এক সময়ে আমাদের সামনে এসেছে যখন বিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারি থেকে পুনরুদ্ধার করতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই যুদ্ধ ইতিমধ্যে ভঙ্গুর বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুতর প্রভাব ফেলেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘গ্লোবাল সাউথের একজন প্রতিনিধি হিসাবে আমি এই সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত লাখো মানুষের কণ্ঠস্বর নিয়ে এখানে যোগ দিয়েছি। স্বল্পোন্নত এবং দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এই পরিস্থিতি উত্তরণে তাদের জন্য দ্রুত সহযোগিতা প্রয়োজন।’
এ সময় এই গ্রুপে যোগ দিতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানোয় জাতিসংঘ মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় দৃঢ় বিশ্বাসী। আমরা সবসময় বিশ্ব শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নে অবদান রাখতে জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। এই গ্রুপটিকে সমর্থন করার জন্য আমাদের প্রতিশ্রুতি সেই প্রত্যয় থেকে এসেছে।’
করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারে আমাদের প্রচেষ্টা ছিল জীবন এবং জীবিকার সুরক্ষায় সতর্ক থেকে ভারসাম্য রক্ষা করা। পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে দুর্বল মানুষদের আমরা সামনে রেখেছি।
‘পেছনে পড়ে থাকা মানুষগুলোর সুরক্ষায় সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোকে আমরা প্রসারিত করেছি। সময়মতো ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে পারা আমাদের বড় ধরনের স্বাস্থ্য সংকট কাটাতে সাহায্য করেছে এবং প্রাণ বাঁচিয়েছে।’
রপ্তানি খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকে রক্ষায় সরকারের নেয়া পদক্ষেপকে বাস্তবসম্মত বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘২৩ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা হয়। এই পদক্ষেপগুলো আমাদের গত অর্থবছরে ৬ দশমিক ৯৪ ভাগ জিডিপি প্রবৃদ্ধির অর্জনে সহায়তা করেছে।’
প্রধানমনন্ত্রী বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি এবং নিশ্চিত করেছি জ্বালানি নিরাপত্তা। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে অত্যন্ত অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সরবরাহ ঘাটতি এবং খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই সাধারণ মানুষের জীবনে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে।’
এই সংকট কাটাতে বিলাসী পণ্য আমদানি বন্ধ রাখা, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ রাখা, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো, এক কোটি পরিবারকে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা, বৈধপথে আসা রেমিট্যান্সের সঙ্গে ২ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ সহায়তাসহ সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
এমন বাস্তবতায় জিসিআরজিকে এগিয়ে নিতে সবার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে বাংলাদেশ প্রস্তুত বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।